ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলেই হাজারো ডকুমেন্ট ও জামানতের ঝামেলায় পড়েননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবেনা। এর ফলে অনেকেই ঋণ নিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তবে বেশ কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান জামানত ছাড়াই গ্রাহককে ঋণ দিয়ে থাকে। এর মধ্যে নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে জামানত ছাড়াই এক কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তফসিলি সব ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ঋণ বিতরণ করছে। এই ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তিখাতের উদ্যোক্তারা অগ্রাধিকার পাবেন। এছাড়া শিক্ষকদের জন্য সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ সেবা চালু করেছে বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংক। কর্মসংস্থান ব্যাংকও জামানত ছাড়াই পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিয়ে থাকে।
শিক্ষকদের জন্য ব্র্যাক ব্যাংকের ২০ লাখ টাকা ঋণ
শিক্ষকতা পেশার প্রতি সম্মান জানিয়ে বিশেষ ঋণ সেবা চালু করেছে বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড। ‘দিশারী’ নামে এই ঋণ দেশের যেকোনো প্রান্তে যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিতে পারবেন। এই ঋণ পেতে জামানতের প্রয়োজন হবে না। পাঁচ বছরে পরিশোধযোগ্য এ ঋণ। আর সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ মিলবে। এ ছাড়া আছে বিশেষ সুদের হার ও দ্রুততম সময়ে ঋণ প্রক্রিয়াকরণ।
সরকারি, বেসরকারি ও এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্র্যাক ব্যাংকের তালিকাভুক্ত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা এ ঋণ নিতে পারবেন। তবে সে জন্য মাসিক বেতন হতে হবে ন্যূনতম ১৭ হাজার টাকা। আগ্রহী শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাদের নিকটস্থ ব্র্যাক ব্যাংক শাখায় অথবা ১৬২২১ নম্বরে ফোন করে এ ঋণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
কর্মসংস্থান ব্যাংকে জামানত ছাড়াই পাঁচ লাখ টাকা ঋণ
দেশের বেকার ও অর্ধবেকারদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য জামানত ছাড়াই ২০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিচ্ছে কর্মসংস্থান ব্যাংক। ‘বঙ্গবন্ধু যুব ঋণ নীতিমালা’র আওতায় বেকার যুবক ও যুব নারীরা ৮ শতাংশ সরল সুদে এ ঋণ পাওয়ার যোগ্য। পাঁচ বছরের জন্য এ ঋণ দেয়া হচ্ছে। তবে এ ঋণ পেতে সরকারি, আধা সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান থেকে আত্মকর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
ঋণ পাওয়ার জন্য একসময় অষ্টম শ্রেণি পাসকে শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল। বর্তমানে তা পঞ্চম শ্রেণি পাসে নামিয়ে আনা হয়েছে। ঋণ আবেদনকারীকে বেকার বা অর্ধবেকার হতে হবে। বয়স হতে হবে ১৮ থেকে ৩৫ বছর। তবে বিশেষ বিবেচনায় ৪০ বছর পর্যন্ত বয়স শিথিলযোগ্য।
এ ছাড়া ঋণ পেতে হলে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বিসিক, বিডা, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনসহ (এসডিএফ) অন্যান্য সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। ঋণখেলাপিরা ঋণ পাওয়ার যোগ্য হবেন না। একই গ্রাহক বা গ্রুপ একাধিক প্রকল্পে ঋণ পাওয়ার যোগ্য বলেও বিবেচিত হবেন না। তবে ৮ শতাংশ সরল সুদে ঋণ দেওয়া হলেও কিস্তি খেলাপি হলে এই সুদ নেওয়া হবে ১০ শতাংশ হারে।
প্রকল্প এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী এবং যার বাড়িঘর ও জমিজমা আছে ও ঋণ পরিশোধে সক্ষম এমন কেউ জামিনদার হতে পারবেন। আবেদনকারীর পিতা, মাতা, স্বামী, স্ত্রী অথবা তৃতীয় কোনো ব্যক্তিও হতে পারবেন জামিনদার। একটি জেলার কোনো বাসিন্দা ওই জেলার আওতাধীন যেকোনো শাখার উদ্যোক্তার ঋণের বিপরীতে নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টি দিতে পারবেন। জামিনদার হতে পারবেন সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরাও।
জামানত ছাড়াই বাংলাদেশ ব্যাংকের কোটি টাকা ঋণ
নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে জামানত ছাড়াই এক কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তফসিলি সব ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ঋণ বিতরণ করবে। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তিখাতের উদ্যোক্তারা অগ্রাধিকার পাবেন। এ ক্ষেত্রে নতুন উদ্যোক্তাদের সহযোগিতার জন্য ‘স্টার্ট-আপ ফান্ড’ নামের ৫০০ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠনের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সম্পূর্ণ জামানতবিহীন এই ঋণ চার শতাংশ সুদে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা পর্যন্ত একজন উদ্যোক্তা নিতে পারবেন। পাঁচ বছরের মধ্যে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল হলেও এটি বিতরণ করা হবে তফসিলি ব্যাংকের মাধ্যমে। দেশের সকল তফসিলি ব্যাংক এই তহবিল হতে ঋণ দিতে পারবেন। তবে যেসব ব্যাংক এই তহবিলের পুনঃঅর্থায়ন সুবিধাগ্রহণ করতে চাইবে, তাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস ডিপার্টমেন্টের সাথে অংশগ্রহণ চুক্তি করতে হবে।
এই ঋণ পেতে হলে একজন উদ্যোক্তাকে তার প্রকল্পের যাবতীয় বিবরণী, পরিকল্পনা, নিজস্ব বিনিয়োগের ধরণ ইত্যাদির বিস্তারিত তুলে ধরে ফর্ম পূরণ করে সংশ্লিষ্ট তফসিলি ব্যাংকে আবেদন করতে হবে। ব্যাংক তার আবেদনে সন্তুষ্ট হলে প্রকল্প মূল্যায়ন করে তার ঋণের পরিমাণ নির্ধারণ করবে।
আবেদনকারী নতুন উদ্যোক্তাকে সরকারি অথবা যথাযথ কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত বেসরকারি উদ্যোক্তা উন্নয়নপ্রতিষ্ঠান থেকে উদ্যোক্তা উন্নয়ন, ব্যবসা পরিচালনা, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি বা অন্য কারিগরি বিষয় (পণ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, যন্ত্রপাতি মেরামত ইত্যাদি) সাফল্যের সাথে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সার্টিফিকেট থাকতে হবে।
ডিগ্রিধারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার মূল সনদ অথবা কারিগরি প্রশিক্ষণের মূল সনদ জামানত হিসেবে ব্যাংকে জমা রাখতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক কারিগরি শিক্ষা না থাকলে উদ্যোক্তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যথাযথ বাস্তব ভিত্তিক জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও নতুন উদ্যোগ পরিচালনার সক্ষমতা থাকতে হবে। সম্পূর্ণ সৃজনশীল উদ্যোগের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তার বয়স হতে হবে ২১ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। ঋণখেলাপি কোনো ব্যক্তি এই তহবিল থেকে ঋণ নিতে পারবেন না।
ঋণ পাওয়ার জন্য ব্যক্তিগত গ্যারান্টি, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ অথবা কারিগরি যোগ্যতার সনদ জামানত হিসেবে বিবেচনা করা যাবে। এসব সনদ ব্যাংকের কাছে জমা রাখতে হবে। ব্যক্তিগত গ্যারান্টি বলতে বোঝানো হচ্ছে, ব্যাংক ও গ্রাহক মিলে উভয়পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যক্তির অঙ্গীকারনামা থাকতে হবে। তবে এ ধরনের ব্যক্তিগত গ্যারান্টি দু’জনের বেশি নেয়া যাবে না। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১০ ভাগ নারী উদ্যোক্তাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। কোনো উদ্যোক্তা যেকোনো একটি উদ্যোগে একবারের বেশি ঋণ নিতে পারবেন না।
স্টার্ট-আপ ফান্ড থেকে যারা ঋণ নেবেন, তাদের তিন কিস্তিতে ঋণ বিতরণ করা হবে। একজন উদ্যোক্তা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন। তবে তা নির্ভর করতে তার প্রকল্পের মূল্যায়নের ওপর। যেখানে ব্যাংকার ও গ্রাহকের সম্পর্কের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ চার শতাংশ সুদে তিন ও ছয়মাস মেয়াদী কিস্তিতে পাঁচ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। স্টার্ট-আপ তহবিলের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। তবে প্রয়োজনে তা আরো বাড়ানো হবে।
বিকাশ-রকেট গ্রাহকরা জামানত ছাড়া পাবেন ৫০ হাজার টাকা ঋণ
বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ডিজিটাল ক্ষুদ্র ঋণ’-এর আওতায় এখন থেকে ঋণ পাবেন মোবাইল ব্যাংকিং গ্রাহকরা। সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত এ ঋণ দেয়া হবে। বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকে এর অর্থায়ন করা হবে। এ জন্য ১০০ কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করা হয়েছে। এর ফলে বিকাশ, রকেট, এমক্যাশ ও উপায়সহ দেশে বর্তমানে ১৩টি মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকরা পাবেন এই ঋণ। তবে ডাক বিভাগের মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস ‘নগদ’ এর গ্রাহকরা এ সেবা পাবেন না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মতে, গ্রাহক পর্যায়ে সুদের হার হবে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সব তফসিলি ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত পুনঃঅর্থায়ন সুবিধার ওপর ১ শতাংশ হারে সুদ আরোপ হবে। ব্যাংক এবং গ্রাহক উভয় পর্যায়ে ঋণের মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ছয় মাস। ঋণ প্রসেসিং থেকে শুরু করে ঋণ আদায় পর্যন্ত সব কিছু ডিজিটাল পদ্ধতিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সময়ে সময়ে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের পরিমাণ কমাতে বা বাড়াতে পারবে।
ঋণ সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ঋণের সহজলভ্যতা ও ব্যাংকের তহবিল ব্যয় হ্রাস করে ‘ডিজিটাল ক্ষুদ্র ঋণ’ প্রদানে এই স্কিম গঠন করা হয়েছে। ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এর ৪৫ ধারার আওতায় এ নির্দেশনা জারি করা হলো। যা কার্যকর হবে অবিলম্বে।
‘ডিজিটাল ক্ষুদ্র ঋণ’ বিতরণকারী সব তফসিলি ব্যাংক এ সুবিধা গ্রহণের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। পুনঃঅর্থায়ন গ্রহণে আগ্রহী ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন ডিপার্টমেন্টের (এফআইডি) সঙ্গে একটি চুক্তি করতে হবে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত মোবাইল ব্যাংকিং-এ নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি ৯১ লাখ ৩০ হাজার ৪০৫টি। আর মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দেয়ার জন্য এজেন্ট রয়েছে ১১ লাখ ৫১ হাজার ২১৩টি।