বাংলাদেশের সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট খাতের শুরু হয় ২০০০ সালের পর থেকে | যদিও এটার পূর্ণতা পাওয়া শুরু করে ২০০৭ এ বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবলে যুক্ত হওয়া এবং ২০০৯ সালের ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার পর থেকে | ২০১১/২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সফটওয়্যার খাত নিতান্তই ইনভেস্টমেন্টবিহীন একটি ছোট সেক্টর হিসেবে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে নাই | কিন্তু বিগত ১০ বছরে সফটওয়্যার খাত দুটো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে | তার মধ্যে একটি হলো দেশীয় বাজারে সফটওয়্যার দিয়ে সক্ষমতা তৈরি এবং অন্যটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন |
এসএমই খাতে এ দেশীয় সফ্টওয়ার পণ্য ও ভ্যাট আরোপের প্রভাব:
দেশীয় এসএমই খাতের বেশিরভাগ সফটওয়্যারই (POS, হিসাব সংরক্ষণ, ব্যবসা পরিচালনা) দেশে প্রস্তুত আছে এবং বাজার চাহিদার বেশিরভাগ দেশীয় সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো পূরণ করছে এবং যথেষ্ট কম মূল্যে । যদিও এই বাজারটিতে ভারত ও শ্রীলঙ্কার কিছু পণ্য যতারীতি বাজারের ভারসাম্য নষ্ট করে | কারণ সফটওয়্যার এর মূল্য কম হওয়ার কারণে এগুলো প্রচলিত পদ্ধতিতে আমদানি হয়না এবং যার ফলে শুল্ক নিয়ে তেমন ঝামেলা পোহাতে হয়না তাদের লোকাল পার্টনারদেরকে| এই খাতের দেশীয় সফটওয়্যার উদপাদনের উপর ভ্যাট আরোপ হলে এটি ভারত, শ্রীলঙ্কা ও অন্যদের হাতে যেতে খুব বেশি সময় লাগবেনা । দেশীয় ব্যবসায়ীদের অনীহা আসার সম্ভাবনা যথেষ্ট| বলা প্রযোজ্য, এই খাতে তেমন কোনো কাস্টম সফটওয়্যার ব্যবহার হয়না কিন্তু অনলাইন থেকে কিছু SaaS পণ্য ক্রেডিট কার্ড বা অন্য পদ্ধতিতে ক্রয় করে ব্যবহার হয় ।
মাঝারি শিল্পে দেশীয় সফটওয়্যার ও ভ্যাট আরোপের প্রভাব:
বিগত ১০ বছরে মাঝারি শিল্পের সফটওয়্যারে বিদেশি পণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশীয় কোম্পানিগুলো নিজেদের ইনভেস্টমেন্ট ও সক্ষমতা বাড়িয়ে বাজারের একাংশ দখলে নিয়েছে | সক্ষমতা ও স্তায়িত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে দেশীয় কোম্পানিগুলো অনেক ক্ষতির সম্মুক্ষিণ হয় এবং সেটা এখনও কাটিয়ে উঠতে বেশ কয়েক বছর সময় প্রয়োজন | মাত্র বাজার দেশীয় সফটওয়্যারে (ERP, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ও অন্যান্য) বিশ্বাস অর্জন করা শুরু করেছে | এই খাত এখনও অনিবন্ধিত বিদেশি ( ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য ) কোম্পানি ও প্রচলিত পদ্ধতীর বাইরে গিয়ে আমদানি শুল্ক ফাঁকি দেয়ার সুযোগ থাকায় দেশীয় কোম্পানি গুলোকে যথেষ্ট কসরত করতে হয় সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে । এই খাতে ভ্যাট আরোপ বিদেশি কোম্পানিগুলোর বাজার আগ্র্রাসনকে সাপোর্ট করার মতো হয়ে যাবে |
মাঝারি খাতে তৈরিকৃত সফটওয়্যার এর পাশাপাশি কাস্টম সফটওয়্যারের (ভ্যাট অনুযায়ী : সার্ভিস খাত) একটা বড় বাজার পরিলক্ষিত হয় যেটার বেশিরভাগ অংশই দেশীয় সফটওয়্যার কোম্পানি গুলো দিয়ে আসছে | কাস্টমার চাহিদা মোতাবেক বাজেট কম থাকার কারণে বেশিরভাগ সময়ই সফটওয়্যার কোম্পানি গুলোকে ক্ষতির সম্মুক্ষিণ হতে হচ্ছে | বাজার সফটওয়্যার এ কাস্টম সফটওয়্যার কেনার দক্ষতা বাড়লে এই ক্ষতির পরিমাণ কমে যাবে | সর্বোপরি, মাঝারি শিল্পের কাস্টম সফটওয়্যার এ ভ্যাট আরোপ কাস্টমার ও সফটওয়্যার তৈরি প্রতিষ্ঠানকে নিঃসন্দেহে বাধাগ্রস্ত করবে|
বৃহৎ শিল্পে দেশীয় সফটওয়্যার ও ভ্যাট এর প্রভাব:
বৃহৎ শিল্প ( ব্যাংক, টেলিকম, মেডিসিন, শিপিং অন্যান্য) খাতে দেশীয় সফটওয়্যারের পরিমাণ যথেষ্ট কম , কিন্তু দেশীয় কোম্পানিগুলো তাদের সক্ষমতা প্রমাণে ইনভেস্টমেন্ট ও সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং বেশ কিছু সফলতার গল্প তৈরি হয়ে আছে | যেটা প্রমাণ করে যে, দেশীয় কোম্পানিগুলোকে সুযোগ দিলে তারা এই খাতে সফটওয়্যার দিয়ে প্রচুর পরিমাণ বিদেশী মুদ্রা বাঁচাতে পারবে | এই খাতের দেশীয় তৈরি পণ্য ( যথা: কোর ব্যাঙ্কিং বা টেলিকম সফটওয়্যার) বা কাস্টম সফটওয়্যারে ভ্যাট আরোপ যতার্থ অর্থনৈতিক ক্ষতি বয়ে আনতে পারে | এই খাতে সফটওয়্যার আমদানি কমানো গেলে অনাখাঙ্খিত মুদ্রা পাচার হওয়ার সম্ভাবনা ও কমে যাবে ।
সরকারি পর্যায়ে দেশীয় সফটওয়্যার ও ভ্যাটের প্রভাব:
বিগত কয়েক বছরে দেশীয় সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সুনামের সঙ্গে ভূমিকা পালন করে আসছে | এই খাতে এর আগেও বিদেশি সফটওয়্যারের ব্যবহারের চাইতে দেশীয় সফটওয়্যারের সফলতা অনেক বেশি, কিন্তু বিদেশি সফটওয়্যার তুলনায় দেশীয় সফটওয়্যারের জন্য সরকারি বাজেট নিতান্তই কম | যার কারণে দেশীয় কোম্পানি গুলো স্তায়িত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদে অনেক ক্ষতির সম্মুক্ষিণ হতে হয় | সঙ্গে এই খাতে ব্যাংক সাপোর্ট নিতান্তই দুর্বল| এই সব দিক বিবেচনা করে সরকারি পর্যায়ে দেশীয় সফটওয়্যার পন্য বা সেবা ভ্যাটমুক্ত ঘোষণা স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে|
বিদেশি সফটওয়্যার ও শুল্ক প্রভাব :
বিদেশি সফটওয়্যার পণ্যগুলো বিশেষত দুই ভাগে ভিবক্ত করা যায় ।
এক: বাজারে নেই বা যেগুলো খুব সহজে তৈরি হবেনা বিভিন্ন কারণে যেমন পর্যাপ্ত ইনভেস্টমেন্ট অথবা টেকনোলজি সক্ষমতা অথবা সময়সাপেক্ষতার কারনে । এই ক্যাটাগরিতে প্রথমেই চলে আসে অপারেটিং সিস্টেম, যেটি গ্রাহক পর্যায়ে মূলত মাইক্রোসফট ভিত্তিক উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার হয় | অন্যদিকে সার্ভার সাইড এর জন্য মাইক্রোফট সহ ওপেনসোর্স ( যেই সফটওয়্যার গুলো মূলত বিনা খরচে বা ক্ষম খরচে ব্যবহার করা যায়) অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার হয় | এই ক্যাটারির দ্বিতীয় সারিতে চলে আসে ডাটাবেস যেটিও আমাদের দেশে তৈরি হয়না কিন্তু প্রচুর পরিমাণ ওপেন সোর্স ব্যবহার হয় | গুরুত্বপূর্ণ স্তাপনা বা কোম্পানিব্যতীত পেইড ডাটাবেস কম ব্যবহার হয় । তৃতীয় সারিতে সিকিউরিটি সফটওয়্যার, এম্বেডডেড সফটওয়্যার ও মেশিন ভিত্তিক সফটওয়্যার গুলো চলে আসে । এই জাতীয় সফটওয়্যার গুলোতে শুল্ক হারের পরিমাণ বাড়ানোতে ( ৫ থেকে ২৫% ) যা রাজস্ব আসবে তার চাইতে বেশি ক্ষতি হবে এই সফটওয়্যার গুলোর বিদেশি ভেন্ডরকর্তৃক বাজারমূল্য বাড়ানোর কারণে | যদিও এই ক্যাটাগরি গুলোতে বিদেশি কোম্পানি গুলো বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের চাইতে অনেক বেশি মূল্য নির্ধারণ করে রেখেছে|
দুই: যেই পণ্য গুলো বাংলাদেশে তৈরি হয় কিন্তু ক্ষেত্র বেঁধে আনা প্রয়োজন বা ডিপ্লোমেটিক প্রয়োজনে উম্মুক্ত বাজার প্রদান করা| উম্মুক্ত বাজার নীতিতে আমাদের দেশে আইনগত প্রক্রিয়া যেকোন দেশ থেকে সফটওয়্যার আসতে পারে | কিন্তু পুরোপুরি সক্ষমতা অর্জন স্বনির্ভরতা অথবা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে দেশীয় পণ্য বা সেবাকে প্রাদান্য দেয়া গুরুত্বপূর্ণ | এই পণ্য গুলার ভ্যাট ও শুল্ক করের পরিমাণ বাড়ানো ক্ষেত্রে ক্যাটাগরি ধরে আরও সুবিন্যস্ত কোড প্রদান ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে স্মার্ট বাংলাদেশের ভিশন পূরণে সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনেক জোরদার হবে |
একটি স্বল্প সময়ের সফলতা:
২০১৮ সালে এনবিআর কর্তৃক দেশীয় সফটওয়্যার কোম্পানি গুলোকে ভ্যাট সফটওয়্যার বানানো ও বাজারজাত করণের নিবন্ধনের ফলে ভ্যাট রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ক্রমাগত অনলাইন হচ্ছে ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাচ্ছে |
লেখকঃ প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, ডিভাইন আইটি লিমিটেড