ঢাকা     ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  ১ পৌষ ১৪৩১

Biz Tech 24 :: বিজ টেক ২৪

ব্যাংকিং সেক্টরে আস্থা পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জ

সাইফুল ইসলাম শান্ত

প্রকাশিত: ১৪:৪৯, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪

ব্যাংকিং সেক্টরে আস্থা পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জ

ব্যাংক খাতে আমানতের সুদহার বাড়ানোসহ নানামুখী চেষ্টা সত্ত্বেও দেশের ব্যাংকগুলোর টাকার অভাব কাটছে না। ফলে, দেশের অর্থনীতি বর্তমানে কিছুটা সংকটের সম্মুখীন, যেখানে ব্যাংকখাত নগদ প্রবাহ সংকট এবং অপ্রদর্শিত ঋণের চাপে ভুগছে। এই সংকটের ফলে আমানতকারীদের মধ্যে আস্থার বড় ধরনের অভাব দেখা দিয়েছে।

সংকটের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে আছে উচ্চ মাত্রার খেলাপি ঋণ, আমানত প্রবৃদ্ধি ও ঋণ পুনরুদ্ধারে ধীরগতি এবং বিশেষ করে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর ব্যাপক আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংকিং খাতে সাধারণ মানুষের অনাস্থার সৃষ্টি। বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন টাকা ছাপিয়ে এ সংকট কাটানোর উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দিতে নতুন করে আর টাকা ছাপানো হবে না। এর পরিবর্তে ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টির বিপরীতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ঋণ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো প্রতিদিনের পরিচালন চাহিদা মেটাতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ঋণ নিতে হিমশিম খাওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নেতৃত্বের বেশকিছু অতিকথন জনমনে আশার আলো সঞ্চারের বিপরীতে অনাস্থা ও হতাশার জন্ম দিয়েছে। আমানতকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলা হলেও চেক, ডিমান্ড ড্রাফট ইত্যাদি নিয়ে টেবিলে টেবিলে ঘুরছেন গ্রাহকরা। কোনো কোনো শাখায় ব্যাংক কর্মচারীদের সঙ্গে ঝগড়া ও ভাংচুরের মতো ঘটনাও ঘটেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নেতৃত্ব আসার পরই বলেছিলেন যে ব্যাংক লুটপাটকারীরা ছাড় পাবে না। তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু বাস্তবে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ এখনো দেখা যায়নি। পর্ষদ ভেঙে দেয়া ব্যাংকের ব্যবস্থাপকদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রায় দেউলিয়াগ্রস্ত যেসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপকরা মালিকদের অন্যায় আবদার মিটিয়েছেন, নামে বেনামে ঋণ দিয়ে নিজেরাও লাভবান হয়েছেন, তারা কীভাবে বহাল তবিয়তে থাকেন? দুর্নীতিবাজ এসব এমডিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে আক্ষরিক অর্থেই তাদের বিচারের মুখোমুখি করা। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাও এসব দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। তাদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে কথার চেয়ে কাজে বেশি মনোযোগ দেয়া। ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা।

মিডিয়ার তথ্যমতে, প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকা ইতোমধ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে চলে গেছে, যা সামগ্রিক অর্থের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টাসহ অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ঘোষণা করেছেন পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন, যদিও এ কাজটি খুবই কঠিন। তবে পাচারকারী ও অর্থ পাচারকৃত দেশ চিহ্নিত করা গেলে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

এমন অবস্থায় নতুন অর্থ মুদ্রণ করে ঘাটতি কিছুটা পূরণ করা হলে এটি দুর্বল ব্যাংকগুলো সমর্থন জোগাবে এবং মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব ফেলবে। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলো, যেমন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং যুক্তরাজ্য অর্থ মুদ্রণের মাধ্যমে তাদের অর্থনীতিকে সহায়তা দিয়েছে। অর্থ মুদ্রণের পাশাপাশি, সরবরাহ শৃঙ্খলা শক্তিশালী করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। বাংলাদেশে সরবরাহ শৃঙ্খলার ব্যাঘাতের কারণে প্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি তৈরি হয়েছে এবং দাম বেড়েছে। লজিস্টিক অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিবহন ব্যবস্থা সঠিকভাবে চালু রাখা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ সুনিশ্চিত করলে মূল্যস্ফীতির চাপে লাগাম টানা সম্ভব হবে। বিশেষ করে খাদ্য ও জ্বালানির মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খলা উন্নত করা হলে এটি ভোক্তাদের জন্য দাম কমাতে সহায়ক হবে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে সরকার মূল্য সীমাসহ প্রাইস ক্যাপ নির্ধারণ করতে পারে। যা ভোক্তাদের জন্য খরচ সীমিত করতে এবং মূল্য বৃদ্ধি রোধ করতে সহায়ক হবে। সেই সঙ্গে বিক্রেতারা নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করছেন কিনা সেটা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে সরকার ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর মাধ্যমে পণ্য বিক্রির স্থান ও পরিধি বৃদ্ধি করতে পারে। বর্তমানে টিসিবি সাধারনত স্থায়ী বাজার থেকে অনেক দূরে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পণ্য বিক্রি করে থাকে। এতে নামমাত্র কিছু পরিবার সুবিধা পেলেও বাজারে এর তেমন কোনা প্রভাব পড়ে না। কিন্তু টিসিবি যদি স্থায়ী বাজারের ভেতরে বা সামনে বাজার চলাকালীন সময় তাদের পণ্য বিক্রি করে তাহলে পূর্ণ প্রতিযোগিতার বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। তাছাড়া নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ওপর আমদানি শুল্ক কমিয়ে বাজারে পণ্য সরবরাহ বৃদ্ধি করতে পারলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদের মতে, রাজনৈতিক সুশাসন নিশ্চিত না করে অর্থনৈতিক সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে সুশাসনের জন্য প্রয়োজন সুবিচার, ন্যায়পরায়ণতা ও দায়বদ্ধতা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে মানুষ অনেক কিছু আশা করছে। সরকারের উচিত হবে, সঠিক জায়গায় এবং সঠিক ব্যক্তিদের ঋণ প্রদান করে অর্থনীতির যেসব খাত ও উপ-খাতগুলো শুকিয়ে গেছে, সেগুলোতে প্রাণের সঞ্চার করা।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এমন এক কঠিন সময় পার করছে, যেখানে আস্থা, স্থিতিশীলতা এবং প্রবৃদ্ধি সবই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ হলেও, বৃহত্তর ঝুঁকি হলো আস্থার অভাব এবং আর্থিক খাতে নগদ টাকার অভাব। এ অবস্থায় টাকা মুদ্রণ এবং সরবরাহ শৃঙ্খলা উন্নয়নের সমন্বিত কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ আরও অর্থনৈতিক অবনতির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে এবং স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করতে পারে। এই পন্থা গ্রহণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনসাধারণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে সহায়ক হবে।

-লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট